বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিশ্বাসের সংকট—কার দায়?
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এক সময় ছিল মানুষের আস্থার প্রতীক। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে যা প্রকাশিত হতো, সেটিই ছিল ‘সত্য’। কিন্তু এখন সেই দৃশ্যপট বদলে গেছে।
আজ পাঠক বা দর্শক অনেক সময় সংবাদ দেখে প্রথমেই প্রশ্ন করেন—“এটা আসলেই সত্যি তো?”
এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তিগত নয়; এটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক সংকটেরও প্রতিফলন।
গণমাধ্যমে আস্থাহীনতার চিত্র
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, জনমানুষের একাংশ সংবাদমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছে।
- একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা,
- তথ্য যাচাই ছাড়া সংবাদ প্রকাশ,
- দলীয় বা কর্পোরেট প্রভাব,
সব মিলিয়ে সাধারণ পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছে।
একই ঘটনার দুটি বিপরীত প্রতিবেদন দুই ভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে—যেখানে তথ্যের চেয়ে অবস্থানই বড় হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক প্রভাব ও সম্পাদকীয় স্বাধীনতা
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কাঠামো এখনো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
অনেক মিডিয়া মালিক নিজের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সংবাদপত্র বা টেলিভিশন ব্যবহার করেন।
ফলে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়, সাংবাদিকরা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেন।
যেখানে সাংবাদিকের কলম স্বাধীন নয়, সেখানে সংবাদও নিরপেক্ষ হতে পারে না।
সামাজিক মাধ্যমের চাপ
ফেসবুক, ইউটিউব ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের যুগে সবাই এখন ‘সংবাদদাতা’।
ফলাফল—তথ্য যাচাইহীন পোস্ট, অর্ধসত্য খবর এবং গুজব ছড়ানো সহজ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, অনলাইন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে অনেক সংবাদমাধ্যম ‘ফার্স্ট, নট ফ্যাক্ট’ (প্রথম, কিন্তু সত্য নয়) নীতিতে চলে যাচ্ছে।
এই তাড়াহুড়োই পাঠকের আস্থার সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাংবাদিকতার পেশাগত সংকট
দেশের অনেক সাংবাদিক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও আর্থিক স্থিতি ছাড়া কাজ করেন।
এ অবস্থায় সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া সংবাদ যাচাই (fact-checking) প্রক্রিয়াকে এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয় না।
ফলে ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য অনিচ্ছাকৃতভাবেও প্রকাশিত হচ্ছে, যা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিচ্ছে।
পাঠকের দায়িত্বও কম নয়
আস্থাহীনতার দায় কেবল সাংবাদিক বা প্রতিষ্ঠানের নয়, পাঠকেরও দায়িত্ব আছে।
তথ্য যাচাই না করে শেয়ার করা, ক্লিকবেইট শিরোনামে বিশ্বাস করা, বা শুধুমাত্র নিজের মতের সাথে মেলে এমন খবর পড়া—এসব আচরণও গণমাধ্যমে বিভাজন ও অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে।
সামনে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি তিনটি পদক্ষেপ—
- স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা: সংবাদ প্রকাশের উৎস ও যাচাই প্রক্রিয়া স্পষ্ট করতে হবে।
- সাংবাদিক প্রশিক্ষণ: নৈতিকতা, তথ্য যাচাই ও ডিজিটাল দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে।
- মিডিয়া লিটারেসি: স্কুল থেকে শুরু করে নাগরিক পর্যায়ে সচেতন পাঠক গড়ে তুলতে হবে।
গণমাধ্যম কেবল সংবাদ দেয় না, সমাজের আয়না হিসেবেও কাজ করে।
যদি সেই আয়নাই মলিন হয়ে যায়, তাহলে সমাজও নিজের প্রতিচ্ছবি হারিয়ে ফেলে।
বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব শুধু সাংবাদিকদের নয়—প্রতিটি নাগরিক, পাঠক ও প্রতিষ্ঠানের।
কারণ, বিশ্বাসই গণমাধ্যমের মূল পুঁজি—যা হারালে সবকিছু হারিয়ে যায়।