বিশ্ব রাজনীতিতে এশিয়ার উত্থান—বাংলাদেশ কোথায়?
বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। যে বিশ্ব একসময় ইউরোপ ও আমেরিকা ঘিরে গড়ে উঠেছিল, সেখানে এখন এশিয়াই হয়ে উঠছে নতুন কেন্দ্র। চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া—এই দেশগুলো শুধু অর্থনীতিতেই নয়, ভূরাজনীতির ক্ষেত্রেও আজ বড় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
এশিয়ার উত্থানের গল্প
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে পশ্চিমা শক্তিগুলো যেমন অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষমতার দৌড়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ২১ শতকে সেই ভারসাম্য ধীরে ধীরে সরে আসছে এশিয়ার দিকে।
চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ভারতও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও কূটনীতিতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনও প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের দিক থেকে শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো (ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া) নতুন উৎপাদনশীল কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “২১ শতক হবে এশিয়ার শতক”—এটি আর শুধু ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন।
বাংলাদেশের অবস্থান ও সম্ভাবনা
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত—যা তাকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
- চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এবং ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি—দুই শক্তিধর দেশই বাংলাদেশকে তাদের আঞ্চলিক সংযোগে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।
- বঙ্গোপসাগরভিত্তিক নৌপথ, বন্দর ও জ্বালানি প্রকল্প এখন আন্তর্জাতিক আগ্রহের কেন্দ্র।
তবে, এই সুযোগগুলোর সঙ্গে আছে চ্যালেঞ্জও। চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা বাংলাদেশের কূটনীতির সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতোমধ্যে বিশ্বের দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশগুলোর একটি। তৈরি পোশাক খাত, রেমিট্যান্স ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেশের অবস্থানকে শক্ত করেছে।
কিন্তু রিজার্ভ সংকট, বৈদেশিক ঋণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এই অগ্রগতিতে ছায়া ফেলছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই প্রবৃদ্ধি কি টেকসই হতে পারবে, এবং বাংলাদেশ কি তার আঞ্চলিক অবস্থানকে অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে পারবে?
কূটনীতিতে ভারসাম্যের রাজনীতি
বাংলাদেশ একদিকে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, অন্যদিকে চীনের অবকাঠামো বিনিয়োগ গ্রহণ করছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—সব পক্ষই চায় বাংলাদেশ তাদের অংশীদার হোক।
এই বহুমাত্রিক সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের বাস্তব কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কাউকে বিরক্ত না করে, সবার সঙ্গে কাজ করার কৌশল।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
এশিয়া যখন বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসছে, তখন বাংলাদেশের উচিত হবে—
- আঞ্চলিক সহযোগিতা (যেমন BIMSTEC, BBIN) আরও সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো,
- প্রযুক্তি, নীল অর্থনীতি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো,
- এবং সর্বোপরি, নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে “প্রতিক্রিয়াশীল” নয়, বরং “প্রস্তুতিমূলক” রূপে গড়ে তোলা।
এশিয়ার উত্থান বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে সুযোগ ও সতর্কবার্তা।
সুযোগ এই কারণে যে, এখনই নিজেকে আঞ্চলিক শক্তির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
আর সতর্কবার্তা এই কারণে যে, বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় ভুল সিদ্ধান্ত নিলে অর্জিত অগ্রগতি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ যদি কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সঠিক দিকনির্দেশনা নিতে পারে, তাহলে এই “এশিয়ার শতকে” তার স্থান হতে পারে দৃঢ় ও সম্মানজনক।